অতঃপর মায়ের পরিচয়ের জয় হলো
ফরিদা আখতার || Friday 27 January 2023 ||এই খবর নারীদের জন্যে স্বস্তি নিয়ে এসেছে, কারণ সন্তানের অভিভাবকত্ব পেতে আজ অনেক নারী লড়াই করছেন, যাদের প্রথম ধাক্কা খেতে হয় তাদের সন্তানের শিক্ষা নিয়ে। অর্থাৎ স্কুলে ভর্তি হওয়া, পরীক্ষা দেয়াসহ যত পর্যায়ে অভিভাকের নাম দিতে হয় সেখানে বাবার নাম না দিলে সমস্যায় পড়তে হয়। মা সন্তান জন্ম দেবেন, তাকে আদর যত্নে মানুষ করবেন, কিন্তু যে মুহূর্তে তার সাথে তার স্বামীর বা সন্তানের সাথে বাবার সম্পর্ক ছেদ হচ্ছে কিংবা পরিচয় দেয়ার মতো হচ্ছে না, তখন মায়ের নাম যথেষ্ট হচ্ছে না। বাবার পরিচয়ই সমাজে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। কোনো সন্তানকে বাবা ফেলে গেছে এবং মা কষ্ট করে মানুষ করছে, এমন অবস্থায় কি সমাজ এগিয়ে আসে?
অবশেষে হাইকোর্ট একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন ২৪ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে। দিনটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে থাকবে। বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দিয়েছেন। রায়ে বলা হয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার্থীর তথ্য-সংক্রান্ত ফরম (এসআইএফ) সংশোধনের মাধ্যমে 'বাবা' অথবা 'মা' অথবা 'আইনগত অভিভাবকের' নাম যুক্ত করতে পারবে। ফলে অভিভাবকের ঘরে বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবক—এই তিন বিকল্পের যেকোনো একটি উল্লেখ করেই শিক্ষার্থীরা ফরম পূরণ করতে পারবে। অর্থাৎ বাধ্যতামূলকভাবে বাবার নাম দেয়ার বিষয়টি আর থাকল না।
অভিনন্দন ব্লাস্ট (বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট), মহিলা পরিষদ এবং নারীপক্ষকে রিট মামলা করার জন্য। এবং অভিনন্দন রিটকারীদের পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম, অ্যাডভোকেট আইনুন্নাহার লিপি ও অ্যাডভোকেট আয়েশা আক্তারকে। রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশগুপ্তকেও ধন্যবাদ, যিনি মামলায় হেরে গিয়েও খুশি হয়েছেন।
ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৭ সালে। ওই বছর ঠাকুরগাঁও জেলার এক তরুণীকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড রাজশাহী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে প্রবেশপত্র দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ সেই তরুণী অত্যাবশ্যকীয়ভাবে বাবার নাম পূরণ করতে পারেনি। অথচ এই সন্তান ও তার মাকে কোনো প্রকার স্বীকৃতি না দিয়ে বাবা চলে গিয়েছিলেন। এবং তারপর ওই তরুণীকে তার মা একাই আদর-স্নেহে বড় করেছেন, কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, কিন্তু শিক্ষার উচ্চ পর্যায় যেতে গিয়ে মেয়েটি বাধা পেল। এসএসসি পর্যায়ের পরীক্ষায় তাকে প্রবেশপত্র দেয়া হয়নি শুধু বাবার নাম পূরণ করতে না পারার জন্য। এর চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কী হতে পারে?
খবরটি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, বিশেষ করে 'বাবার পরিচয় নেই, বন্ধ হলো মেয়ের লেখাপড়া' শিরোনামে ২০০৭ সালের ২৮ মার্চ দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদনটি দৃষ্টি কেড়েছিল। সেই তরুণী শেষ পর্যন্ত এসএসসি পরীক্ষা দিতে পেরেছিল কি না আমি কোনো পত্রিকায় দেখিনি। তবে পত্রিকার প্রতিবেদনের কারণে এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনটি সংগঠন রিট করেছিল ২০০৯ সালের ২ আগস্ট। মূল বিষয় ছিল সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মায়ের অধিকারের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠা করা। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৩ আগস্ট বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহম্মেদ এবং বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ মানবাধিকার, সমতার পরিপন্থি ও বিশেষভাবে শিক্ষার অধিকারে প্রবেশগম্যতার বাধাস্বরূপ বিদ্যমান বৈষম্যমূলক এ বিধানকে কেন আইনের পরিপন্থি এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, এ মর্মে রুল জারি করেছিলেন। কিন্তু তারপরও দীর্ঘদিন এই বিধান জারি ছিল কী করে ভাবতে অবাক লাগছে।
বাবার নাম বাধ্যতামূলক থাকাটা খুবই অবমাননাকর এই জন্যে যে বিশেষ কিছু পরিস্থিতি থাকে যেখানে বাবার নাম উল্লেখ করা কঠিন হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে সন্তানকে লালন পালন করে শিক্ষিত করে তোলার যে চেষ্টা মা চালিয়ে যান, তাতে আইন বা 'নিয়ম' বাধা হয়ে গেলে তাদের আর কোনো উপায় থাকে না। মাকে অপমান করা হয়, সমাজের কাছে হেয় করা হয়।
এরপরের ঘটনাক্রম হচ্ছে, ২০২১ সালের ৬ জুন ব্লাস্ট আবেদনকারীদের পক্ষে একটি সম্পূরক হলফনামা আদালতে দাখিল করে। এবং শেষ পর্যন্ত ২০২৩ সালে সুস্পষ্ট রায় পাওয়া গেল। অর্থাৎ চূড়ান্ত রায় পেতে এক যুগের বেশি সময় লেগেছে—২০০৯ সালের রায় মিলেছে ২০২৩ সালে। অর্থাৎ এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শিক্ষার অধিকার খর্ব হচ্ছে জেনেও এমন একটি বঞ্চনামূলক, বৈষম্যমূলক নিয়ম বজায় ছিল, এমনকি তা সংবিধান পরিপন্থি হলেও তা অব্যাহত ছিল। এটা আরও বেশি লজ্জার বিষয়।
নিঃসন্দেহে তবুও এই খবর নারীদের জন্যে স্বস্তি নিয়ে এসেছে, কারণ সন্তানের অভিভাবকত্ব পেতে আজ অনেক নারী লড়াই করছেন, যাদের প্রথম ধাক্কা খেতে হয় তাদের সন্তানের শিক্ষা নিয়ে। অর্থাৎ স্কুলে ভর্তি হওয়া, পরীক্ষা দেয়াসহ যত পর্যায়ে অভিভাকের নাম দিতে হয় সেখানে বাবার নাম না দিলে সমস্যায় পড়তে হয়। মা সন্তান জন্ম দেবেন, তাকে আদর যত্নে মানুষ করবেন, কিন্তু যে মুহূর্তে তার সাথে তার স্বামীর বা সন্তানের সাথে বাবার সম্পর্ক ছেদ হচ্ছে কিংবা পরিচয় দেয়ার মতো হচ্ছে না, তখন মায়ের নাম যথেষ্ট হচ্ছে না। বাবার পরিচয়ই সমাজে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। কোনো সন্তানকে বাবা ফেলে গেছে এবং মা কষ্ট করে মানুষ করছে, এমন অবস্থায় কি সমাজ এগিয়ে আসে? উল্টোদিকে বাবার নাম দেয়ার পর মায়ের নাম না দেয়ার কারণে কোনো শিক্ষার্থীর প্রবেশপত্র আটকানো হয়েছেন কি না আমরা শুনিনি। বাবার নাম এত বড় ব্যাপার!
হাইকোর্টের এই রায়ের ফলে বাবা-মা ছাড়াও আইনগতভাবে 'বৈধ অভিভাবকের' নাম লিখতে পারবে যে-কেউ। এটা খুব ভালো হয়েছে। অর্থাৎ মা-বাবার পরিচয়হীন যেকোনো শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত হলো। যদিও এই বৈধ অভিভাবকের বিষয়টি আদালতের মাধ্যমেই ঠিক হবে। রিটকারীদের পক্ষের আইনজীবীরা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে পিতৃপরিচয়হীন সন্তান, যৌনকর্মীদের সন্তান যাদের বাবার পরিচয় নেই, তারা শুধু মায়ের নাম দিয়েই ফরম পূরণ করতে পারবেন। এসএসসি, এইচসি পরীক্ষার ফরমসহ শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে ফরম পূরণ ছাড়াও পাসপোর্টের ফরম পূরণে বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবকের নাম লেখা যাবে। এই রায়ের ফলে বাবা-মায়ের উভয়ের নাম লেখার বাধ্যবাধকতা থাকবে না, এমন বিধান প্রতিষ্ঠিত হলো। শুধু মায়ের নাম লিখেও ফরম পূরণ করা যাবে।
একটা সময় ছিল, যখন সব ধরনের ফরমে ছেলে-মেয়েদের জন্য শুধু বাবার নাম এবং বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে স্বামীর নাম দিতে হতো। অনেক আন্দোলনের পর সেখানে বাবার নামের সাথে মায়ের নাম যুক্ত হয়েছে। এটাও আন্দোলনের কারণে হয়েছে।
এটা নিঃসন্দেহে একটা অগ্রগতি, কিন্তু কাজ আরও অনেক বাকি আছে। একটা সময় ছিল, যখন সব ধরনের ফরমে ছেলে-মেয়েদের জন্য শুধু বাবার নাম এবং বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে স্বামীর নাম দিতে হতো। অনেক আন্দোলনের পর সেখানে বাবার নামের সাথে মায়ের নাম যুক্ত হয়েছে। এটাও আন্দোলনের কারণে হয়েছে।
তবে মায়ের নাম যুক্ত করার সাথে সন্তানের অভিভাকত্ব পাওয়ার লড়াই শেষ হয়েছে বলা যাবে না। এই লড়াই ভিন্ন আইনি লড়াই। আমি আইনজীবী নই, সেই বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারব না। তবে বাবার নাম বাধ্যতামূলক থাকাটা খুবই অবমাননাকর এই জন্যে যে বিশেষ কিছু পরিস্থিতি থাকে যেখানে বাবার নাম উল্লেখ করা কঠিন হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে সন্তানকে লালন পালন করে শিক্ষিত করে তোলার যে চেষ্টা মা চালিয়ে যান, তাতে আইন বা 'নিয়ম' বাধা হয়ে গেলে তাদের আর কোনো উপায় থাকে না। মাকে অপমান করা হয়, সমাজের কাছে হেয় করা হয়। তাই বাবার নাম থাকার বাধ্যবাধকতা কোনো ক্ষেত্রেই না থাকা ভালো। যারা স্বেচ্ছায় নাম দিতে চাইবেন তারাই দেবেন, আর যারা চাইবেন না তারা দেবেন না। এই অন্যায় বিধান থেকে মুক্তি পাওয়া আমাদের জন্যে খুব জরুরি।
মানুষের পরিচয় মানুষ নিজেই, তার কর্ম, তার আচরণ। বাবার নামের বাধ্যবাধকতা একজন মানুষের সেই পরিচয়কে আঘাত করে এবং যে নারী তার সন্তানকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চান তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সন্তানের অভিভাকত্ব নিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদের পর আইনি লড়াই করে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন বহু নারী; গ্রামে-গঞ্জে স্বামী যখন ইচ্ছা স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে সন্তানকে নিয়ে যাচ্ছেন অথবা দিয়ে যাচ্ছেন দায়িত্বহীনভাবে। অন্যায়-অবিচার চলছে, এই অন্যায়ের শিকার হচ্ছেন হাজার হাজার নারী। কোথায় থাকে তখন সমাজ? কেউ কি গিয়ে তখন বাবাকে ধরে এনে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়? না দেয় না।
এই রায় একটি ধাপ এগিয়ে দিল, কিন্তু থামলে চলবে না। আরও কাজ বাকি আছে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য
এই লেখাটি ২৬ জানুয়ারি, ২০২৩ তারিখে 'অতঃপর মায়ের পরিচয়ের জয় হলো' এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।
ফরিদা আখতার: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী